•|••|• বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ •|••|•
এই ঋজু এই...তোকে না বলছি... কাঠ গোলাপ ফুলগুলোকে কখনো বাইরে ফেলবি না...নষ্ট ফুলগুলোকে মাটিতে পুঁতে ফেলবি... তোকে এই কথাটা আমাকে কেন বার বার বলতে হয়...একবার বললে কানে যায় না ??
এই মেঘলা কি হইসে তোমার...? সকাল সকাল ঋজুকে কেন বকা দিচ্ছ...
দেখ অনিম আমার সব বিষয় নিয়ে তুমি মাথা ঘামাবা না... আর তুমি খুব ভালো করে জানো আমি কেন ঋজুকে বকা দিছি... ওকে আমি সবসময় বলি বাগানের দক্ষিণ কোণের কাঠগোলাপ গাছের ফুলগুলো মাটিতে পরে নষ্ট হয়ে গেলে সেগুলকে সে যেন মাটিতে পুঁতে ফেলে। তুমি তো দেখ সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে আমি এই কাজটা নিজেই করি... আর ফাজিল ঋজু আমি না দেখলে নষ্ট ফুলগুলোকে মাটিতে না পুঁতে বাইরে ফেলে দেয়...ওকে যে কোনদিন আমি বিদায় করি দেই ।
আচ্ছা বাবা হইছে ঋজুকে আর বিদায় করতে হবে না... আমি না হয় ঋজুর হয়ে কাজটা করে দিব...খবরদার অনিম তুমি ভুলেও এই কাজটা করতে যাবা না...তুমি কাঠ গোলাপ স্পর্শ করবে না...আমি তোমাকে এর আগেও নিষেধ করছি...আর এখনও করছি never ever…
কিন্তু মেঘলা কেন ?? তুমি আমাকে কাঠ গোলাপ কেন ছুঁতে দাও না...? তোমার কাছ থেকে বার বার এই প্রশ্নের উত্তর জানতে গিয়ে আমি হতাশ হয়েছি...কি আছে এই কাঠ গোলাপে...?? তোমার আমার বিয়ের দিন রাতে তুমি আমাকে বললে “আপনার কাছে একটা জিনিস চাইব...আমাকে plz না করবেন না । আমাকে একটা কাঠ গোলাপের চারা এনে দিবেন... আমি বাগানের দক্ষিণ কোণে লাগাবো...জানালা দিয়ে দক্ষিণা বাতাসে কাঠগোলাপ আমায় ছুঁয়ে যাবে ...”
থাক ... থাক আর বলতে হবে না ... সব মুখস্ত হয়ে গেছে তাই না....সকাল সকাল এত কিছু না বললে হয় না...বয়স তো বাড়ছে সেটা মনে আছে...আর ঘরে যে আমাদের ক্লাস নাইন এ পড়া একটা মেয়ে আছে সে বিষয়ে খেয়াল আছে...এসব শুনলে সে কি ভাব্বে ??
রোদ...রোদ... মামনি ঘুম থেকে উঠো ... এই রোদ ...... !!
প্রায় প্রতিটা সকালে বাবা-মা’র এমনি কিছু কথা শুনে আমার ঘুম ভাঙ্গত...আমার বাবা মাকে খুব ভালো বাসত...আজ ২৫ দিন হয় মা মারা গেছে... সকাল বেলার বাবা আর মা’র ঐ কথাগুলোকে অনেক miss করতেছি...সকাল বেলা কেউ আর ডাকবে না “রোদ” বলে...কপালে চুমু দিয়ে বলবে না মামনি ঘুম থেকে উঠো...আমি ঘুম থেকে উঠে যখন মা কে জড়িয়ে ধরতাম মা’র শরীর থেকে কাঠ গোলাপের সুন্দর একটা গন্ধ আসতো...মা যে কেন কাঠগোলাপের এত পাগল ছিল তা জানতাম না... বাবাও জানত না...!! মা কাঠগোলাপ দেখলে দিশেহারা হয়ে যেত...
ঠিক ২৫ দিন আগে বিকাল বেলা ঝুম বৃষ্টির মধ্যে আমি, বাবা আর মা মিলে গাড়িতে করে যাচ্ছিলাম সেন্ট্রাল রোড দিয়ে ...ঐ রোডের মাঝা-মাঝি একটা বড় কাঠগোলাপ গাছ আছে। ঐ রোড দিয়ে মা যখনি যায় তখন রাস্তায় কোন কাঠ গোলাপ পড়ে থাকলে মা গাড়ি থেকে নেমে ফুলগুলোকে কুঁড়িয়ে আনত । এবারও মা গাড়ি থেকে নেমে কাঠ গোলাপ আনতে গেল... বাবা মানা করল যেও না বৃষ্টিতে। বৃষ্টিতে কাঠ গোলাপ দেখলে মা দিশেহারা হয়ে যেত ... বুঝতাম না কেন ?? মা শুনলো না বাবার কথা ...... অনেক কাঠগোলাপ রাস্তায় আর ফুটপাথে পড়ে ছিল... গাড়িটাকে ড্রাইভার চাচা রাস্তার অন্য দিকে অনেক পিছনেই রেখে ছিলেন... আমি আর বাবা গাড়িতে বসে মা’র কাঠগোলাপ কুঁড়ানো দেখছিলাম...বাবা বলছিল তোর মা একটা পাগল, যখন ঠাণ্ডা লাগবে তখন বুঝবে... মা ফুটপাথের সব ফুলগুলোকে কুঁড়িয়ে নেবার পর রাস্তার ফুলগুলোকে কুঁড়াবার জন্য নিচে নামলো আর বৃষ্টিও বেড়ে গেল...দেখা যাচ্ছিলো না সবকিছু ঠিকমত। অনেক বৃষ্টির সাথে দমকা হাওয়া... মা পিছন ফিরে ফুল কুঁড়াচ্ছিল। হঠাৎ একটা পিকাপ ভ্যান সজোরে মাকে পাশ থেকে ধাক্কা মেরে চলে গেল। আমি আর বাবা একটা চিৎকার দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে দেখলাম সব শেষ... মা নিথর হয়ে পড়ে আছে রাস্তায় ।মা’র মাথা ফেটে রক্তে রাস্তা একাকার...বৃষ্টিতে রক্ত ধুয়ে যাচ্ছিলো... আর পাশে ছড়িয়ে ছিল কিছু রক্তে রাঙ্গা কাঠগোলাপ... ল্যাব এইড হসপিটালে মাকে নিয়ে যাবার পর ডাক্তাররা মাকে মৃত ঘোষণা করলেন। বাবা মাকে আমাদের বাড়ির বাগানে মা’র প্রিয় কাঠগোলাপ গাছের নিচে কবর দিলেন। এখন আর ঋজু চাচাকে কেউ বকা দেয় না, বলে না বিদায় করে দিবে। চাচা এখন প্রায় কাঁদে আর কাঠগোলাপ ঠিকই মাটিতে পুঁতে রাখে।
.......................... .......................... ..........................
রোদ...রোদ... মামনি ঘুম থেকে উঠ ... এই রোদ !!! না মা না বাবা ডাকছে...
-বাবা আমি অনেক আগেই উঠেছি...
মামনি নাস্তা খেয়ে নিস... আমি অফিসে গেলাম...
ঠিক তখন দরজার কড়া নেড়ে ঋজু চাচা আমাকে বললেন... মামনি আমি একটা চাবি পেয়েছি তোমার মা’র Reading room এর কাছে...
চাচা আমি না তোমাকে বলেছি ঐ room এর কাছে তুমি যাবে না... বাবা পছন্দ করে না ... দেখ না আমিও যাই না।
না মামনি আমি ঐ room ঢুকি নাই। ঝাড়ু দেবার সময় দেখলাম দরজার কাছে এই চাবিটা পড়ে আছে …
চাবিটা দেখে মনে হল কোন ড্রয়ার এর চাবি...আচ্ছা চাচা তুমি যাও...বাবা বাড়িতে নেই... আজ মা’র Reading room -এ ঢুকব। যা ভাবা তাই কাজ...পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে চাবিটা ঢুকাতেই ড্রয়ার খুলে গেল। টান দিয়ে খুলতেই কাঠগোলাপের গন্ধ পেলাম... ভিতরে কিছু শুকনো কাঠগোলাপ আর একটা পুড়নো ডাইরি। কাভারটা খুলতেই দেখি নাম লিখা “অরণ্য আরিয়ান” আর তার কিছু নিচে লেখা “মেঘলা”। ভিতরে অনেক কিছু লিখা... প্রথমে এক ধরনের হাতের লেখা ...কয়েক পৃষ্ঠা পর আমার মায়েরও হাতের লিখা ...খুঁজে পেলাম। অনেক অবাক হলাম...ডাইরিতে আম্মুর নাম ... আবার আম্মুর হাতের লেখা ??
কিছু তো একটা আছে ডাইরিটাতে...অনেক কৌতূহল নিয়ে পড়তে ডাইরিটা পড়তে লাগলাম। প্রথম কয়েক পৃষ্ঠা এমনি লিখা ছিল...
“- এই যে আপনি, শুনছেন ??
আমাকে একটা ফুল পেড়ে দিন না
এই যে Mr !! আরে হ্যাঁ আপনাকে বলছি !! Plz একটা ফুল পেড়ে দিন না...??
[আষাঢ়- শ্রাবণ মাস ... কয়েকদিন ধরে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে ... আজ ছাতা আনতে ভুলে গেছি। বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে বাসায় যাচ্ছিলাম । একটু আগে স্টুডেন্টের বাসা থেকে বের হয়েছি... আগের থেকে বৃষ্টি আরও বেড়েছে... ঝুম বৃষ্টি সাথে দমকা হাওয়া... ভালোই লাগছিল। রাস্তায় দেখি একটা মেয়ে বৃষ্টির মধ্যে লাঠি দিয়ে কাঠ গোলাপ পাড়ার বৃথা চেষ্টা করছিল... ফুলগুলো ছিল ওর নাগালের বাইরে। এই দৃশ্য দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিলাম... হঠাৎ ......এই যে আপনি, শুনছেন ?? ]
আমি ??
-হ্যাঁ , আপনি ... Plz একটা ফুল পেড়ে দিন না ...কাঠগোলাপ আমার অনেক প্রিয় ফুল। বৃষ্টিতে ভিজলে ফুলগুলোকে অনেক সুন্দর লাগে...সাদা ফুলের মাঝে হলুদের আভা... plz..দিন না।
[মনে মনে ভাবছিলাম... আরে মহা মছিবতে পরলাম তো। চিনি না জানি না ... বৃষ্টির মধ্যে একটা মেয়ে বলে ফুল পেড়ে দিন !!]
-আরে মশাই কি এত ভাবছেন... দেখছেন যে ফুলগুলো আমার নাগালের বাইরে ।
আচ্ছা দিচ্ছি...
[ ওর হাতের লাথিটা নিয়ে আমি বৃষ্টির মধ্যে গাছে উঠে ওকে এক থোকা ফুল পেড়ে দিলাম। ]
এই যে আপনার কাঠ গোলাপ...
-Thnx… many many thanx…. আচ্ছা আমি যাই ...by
[মেয়েটা অনেকটা সামনে গিয়ে...পিছনে ফিরে আবার কাছে এসে...]
-Ooo Sorry…!!! আমি মেঘলা , আপনি ?
আমি অরণ্য ...
-আপনি কি করেন ?
এইতো বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় ঘুরি-ফিরি , আর মাঝে মাঝে মেয়েদের ফুল পেড়ে দেই।
-Hahaha......হাসালেন... ,রাগ করেছেন আপনাকে ফুল পাড়তে বলার জন্য ??
না রাগ করবো কেন ...এমনি দুষ্টামি করলাম । ”
[আমি অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে দেখছিলাম... কি সুন্দর ভাসা ভাসা চোখ... কাজল দেয়াছিল চোখে...। বৃষ্টিতে চোখের কাজল ধুয়ে পড়ছিল গোলাপি গালদুটো বেয়ে... সেই দিকে তার মোটেও খেয়াল ছিল না]
.......................... .......................... .................
“রোদ... মামনি তুমি কোথায়... খাবে না ?” ঋজু চাচা খেতে ডাকছে ...
আরে !! এই লোকটা তো আমার আম্মুর কথাই তার ডাইরিতে লিখেছে । আম্মু যখন চোখে কাজল দিত তখন আম্মুকে অনেক সুন্দর লাগত। আমি ডাইরিটা সাথে করে নিয়ে এলাম... খাওয়া শেষ করে আবার পড়তে শুরু করলাম...
.......................... .......................... .......................... ......
আমি CSE তে পড়ি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে...
আপনি?
-আমি মাত্র SSC দিলাম...
তা আপনি কি এইখানে থাকেন ?
-হ্যাঁ... ওইটা আমাদের বাসা...
আচ্ছা আজ আমি আসি... আর একদিন কথা হবে...
-আচ্ছা, ভালো থাকবেন।
[কয়েক দিন পর আমি রিক্সায় করে একটা স্কুলের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। সেদিনও বৃষ্টি ছিল...তবে অল্প... কি যেন মনে হল ভাবলাম নেমে আম ভর্তা খাব... গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে আম ভর্তা ভালোই লাগবে একটু টক একটু ঝাল...যদিও তখন আমের সিজনের যাই যাই অবস্থা । মুখে দিতে যাচ্ছিলাম ... ]
-এই যে আপনি ? অরণ্য ...একা একা আম খাচ্ছেন ?? এটা কি ঠিক ?
আরে আপনি কেমন আছেন?
-হুম ভালো... আমিও আম ভর্তা খাব।
[কি মেয়েরে বাবা একবার বলে ফুল পেড়ে দিন এখন আবার আম ভর্তা !! আমরা দুজন মিলে আম ভর্তা খাচ্ছিলাম। বেখেয়ালি বৃষ্টি হঠাৎ বেড়ে গেল... আমি দুষ্টামি করে বললাম.........]
আজও কি কাঠগোলাপ পেড়ে দিতে হবে ??
-আল্লাহ ... আমার মনেই ছিল না !! thnx…হুম দিতে হবে... চলেন...
[কি আর করা খাল কেটে কুমির আনলাম আমি...গেলাম দুজন মিলে ওদের বাড়ির সামনে ফুল পাড়তে। এভাবেই বৃষ্টিতে আমাদের দিন গুলো যাচ্ছিলো... একটা বিষয় খেয়াল করে দেখলাম বৃষ্টিতে মেঘলার সাথে আমার প্রায় দেখা হয়... অন্যথায় হয় না...মেয়েটার মায়ায় আটকে গেলাম। জীবনের এত গুলো শ্রাবণ পার করে দিলাম কিন্তু তেমন কেউ এল না যাকে নিয়ে শ্রাবণে ভিজবো। যে শুধু থাকবে আমার অনুভূতি জুড়ে । যাকে সাথে নিয়ে বৃষ্টি ভেজা কোন পথের বাঁকে কাকভেজা হব।
রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা মনে পড়ে গেল
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না.....
কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না.... ]
.......................... .......................... ........
ডাইরির পরের পেজেগুলো খুঁজে অরণ্যের আর কোন লেখা পেলাম না ।
প্রায় শেষের দিকে আমার আম্মুর কিছু লেখা পেলাম...আর কিছু কাজল ধোয়া ফোঁটার ছাপ পেলাম লেখাগুলোতে । সবার প্রথমেই লেখা...
“ বিধাতা এমন কেন অরণ্য ? কেন আমার কাছ থেকে তোমাকে কেঁড়ে নিল...??”
[ ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে তুমি আমার বাসার সামনে আসলে... আমি বারান্দায় ছিলাম। তোমাকে দেখে তোমার সাথে বের হলাম... আজ আর বললাম না কাঠগোলাপ চাই... বললাম...... ]
- আপনি কি পারবেন, আমাকে একটা বৃষ্টিভেজা কদম ফুল এনে দিতে ?
ভেজা কদমের পাপড়িগুলো ছড়িয়ে দেবে আমার মনে, প্রানে...
হুম দিব...চলেন ...
[ তুমি আর আমি মিলে চলে গেলাম আমার স্কুলের কাছে... স্কুলে একটা কদম গাছ ছিল। যখন আকাশ ভেঙ্গে মুষল ধারে বৃষ্টি নামতে লাগল তুমি আমি গিয়ে দাঁড়ালাম ঐ কদম গাছের নিচে।বৃষ্টির ফোঁটা ভেজা কদমের পাপড়ি ছুঁয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল আমাদের উপর। আর থাকতে পারলাম না বৃষ্টির কারণে। তুমি বললে... ]
চলেন... স্কুলের ভিতরে যাই।
[ তুমি আর আমি একটা ক্লাস রুমে গিয়ে ঢুকলাম ।দুজনেই ভিজে চুপচুপে ।আমি শীতে অনেক কাঁপছিলাম... ইচ্ছা করছিল তোমায় জড়িয়ে ধরি। তোমাকে অনুভব করি অন্তরের গহীনে হৃদয়ের অন্তরালে। আমি যে তোমাকে ভালবেসে ফেলেছিলাম অরণ্য ।আমি জানলার গ্রিল ধরে দাড়িয়ে ছিলাম হঠাৎ তুমি বললে.........]
"আকাশের কিছু দুঃখ আছে তাই অঝোরে ঝরে বৃষ্টি হয়ে কান্না ঝরায় "
- তাই ...??
হুম...
আকাশ তার অবিরাম বৃষ্টির ধারায় খুঁজে ফেরো অনেক প্রশ্নের উত্তর... সরল, গড়ল, পাওয়া না পাওয়ার আরও অনেক ...আর তুমি আমি খুঁজে ফিরি আমাদের
[ এই প্রথম তুমি আমাকে তুমি বললে...]
খোলা জানালা, অবিরাম বৃষ্টি । বৃষ্টি ধারায় ভেসে যাব শুধু আমরা দুজনে...
জানালার গ্রিল ধরে তুমি -আমি বৃষ্টি দেখি... আর অদূর ভবিষ্যতের ভাবনার অতলে ডুবে যাই। তুমি হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখলে আকাশের জল কান্না, আর ছিটিয়ে দিলে আমায়, আমি হাসলাম...
তুমি বললে -এখন তুমি বেশ ভালোই জানো বৃষ্টি রহস্য, চিনতে শিখেছ বৃষ্টির জল কান্না, কালো মেঘদের অর্থ...
[ হটাৎ আমার চোখের কার্নিশ গড়িয়ে ঝরে পড়তে লাগল অঝোর শ্রাবণ... তুমি দিশেহারা হয়ে বললে ......]
ভয় পেও না...আজ আমি আছি তোমার পাশে... থাকব চিরকাল...
আর আমার দু চোখের অশ্রু মুছিয়ে দিলে তোমার অপার ভালোবাসায়.... আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম । আমি ঠিক এই মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষায় ছিলাম।
বৃষ্টি শেষে যখন তুমি আমায় ছেড়ে যাচ্ছিলে আমি বলেছিলাম... কাল আমার সাথে স্কুলের সামনে দেখা করবে ১১ টায়... কাঠগোলাপ নিয়ে আসবে কিন্তু...তুমি হাসলে আর বললে আমার ডাইরিটা কাল আমি তোমায় দেব...এখন থেকে তুমি লিখবে...
আচ্ছা দিও...আমি এখন যাই।
সারাটা রাত আমার ঘুম আসছিল না... এত খুশি ছিলাম... আমি তোমায় পেয়েছি আর কি চাই...আর ভাবছিলাম কখন যে সকাল হবে আর তোমায় দেখব...
সকাল বেলা প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টির মধ্যেও আমি ১০.৩০-এ স্কুলের সামনে হাজির। বার বার হাত ঘড়ি দেখছিলাম... কখন যে ১১ টা বাজবে, আর তুমি আসবে। আমি স্কুলের গেটের সামনেই ছোট্ট একটা ছাউনির নিচে ছিলাম। আর তোমার পথের পানে তাকিয়ে ছিলাম। ১১ টা বাজার ঠিক ৫ মিনিট আগে তোমাকে দেখলাম তুমি রিক্সায় । হাতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ আর এক ছোপা কাঠগোলাপ ফুল , ফুলগুলো বৃষ্টিতে ভিজছিল। আমি দৌড়িয়ে গেলাম তোমার দিকে... তুমি রিক্সা থেকে নেমে একটু হেসে আমার দিকে যেই এক পা বাড়ালে...হঠাৎ কোথা থেকে একটা গাড়ি এসে তোমায় ধাক্কা মারল। মনে হল আমার পৃথিবী থমকে গেছে। তোমার হাত থেকে প্লাস্টিকের ব্যাগটা ছিটকে গেল।তুমি রাস্তায় পড়ে আছ। তোমার মাথা ফেটে রক্তে রাস্তা একাকার...বৃষ্টিতে রক্ত ধুয়ে যাচ্ছিলো... আমি কাছে গিয়ে দেখলাম তোমার ঠোট দুটি কাঁপছিল... আর তখনও হাতে ছিল কাঠগোলাপ...আমি তোমার কাছে গিয়ে মাথাটা আমার কোলে রাখতেই তুমি আমাকে বলেছিলে মেঘলা আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি... অনেক। নিথর হয়ে পড়ে রইলে তুমি আমার কোলে আর নির্বাক আমি । আমাদের ঘিরে ছিল রাস্তার মানুষগুলো...
আমার আর বুঝতে বাকি রইল না আম্মু আর বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ রহস্য ।তারই অনেকগুলো পৃষ্ঠার পর আম্মুর আরও কিছু লেখা পেলাম...
“অরণ্য জানো... আমি এখন বিবাহিত...আমার একটা মেয়েও আছে। তার নাম রোদ। জানো আমাদের বাড়ির দক্ষিণ কোণে আমি একটা কাঠগোলাপ গাছ লাগিয়েছি। বার মাস সেটাতে ফুল ফোটে আর আমাকে তোমার কথা মনে করিয়ে দেয়। আমি এখন একাই কাঠগোলাপ পাড়ি...তোমাকে লাগে না। জানো আমার Husband আমাকে অনেক ভালবাসে, আমিও চেষ্টা করছি তাকে ভালবাসার। কিন্তু কেন যেন পারছি না। আমি তাকে কোন দিন বলিনি তোমার আমার কথা। অরণ্য আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি... অনেক। তাই বলে আমি আমার Husband কে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করি নি । তাকে আমি তোমার আমার কথা বলি নি কেন জানো ??
কারণ সে থাকে শীতল নীড়ে , শত আনন্দের ভীড়ে...আমি চাই সে এভাবেই থাকুক। আমি ভাল আছি আমার জগৎটাকে ঘিরে...আজো আমার স্বপ্ন ছেড়া কল্পনাতে তোমার বসবাস... হয়ে তুমি আমার দীর্ঘশ্বাস....”
.......................... ............
এই ঋজু এই...তোকে না বলছি... কাঠ গোলাপ ফুলগুলোকে কখনো বাইরে ফেলবি না...নষ্ট ফুলগুলোকে মাটিতে পুঁতে ফেলবি... তোকে এই কথাটা আমাকে কেন বার বার বলতে হয়...একবার বললে কানে যায় না ??
এই মেঘলা কি হইসে তোমার...? সকাল সকাল ঋজুকে কেন বকা দিচ্ছ...
দেখ অনিম আমার সব বিষয় নিয়ে তুমি মাথা ঘামাবা না... আর তুমি খুব ভালো করে জানো আমি কেন ঋজুকে বকা দিছি... ওকে আমি সবসময় বলি বাগানের দক্ষিণ কোণের কাঠগোলাপ গাছের ফুলগুলো মাটিতে পরে নষ্ট হয়ে গেলে সেগুলকে সে যেন মাটিতে পুঁতে ফেলে। তুমি তো দেখ সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে আমি এই কাজটা নিজেই করি... আর ফাজিল ঋজু আমি না দেখলে নষ্ট ফুলগুলোকে মাটিতে না পুঁতে বাইরে ফেলে দেয়...ওকে যে কোনদিন আমি বিদায় করি দেই ।
আচ্ছা বাবা হইছে ঋজুকে আর বিদায় করতে হবে না... আমি না হয় ঋজুর হয়ে কাজটা করে দিব...খবরদার অনিম তুমি ভুলেও এই কাজটা করতে যাবা না...তুমি কাঠ গোলাপ স্পর্শ করবে না...আমি তোমাকে এর আগেও নিষেধ করছি...আর এখনও করছি never ever…
কিন্তু মেঘলা কেন ?? তুমি আমাকে কাঠ গোলাপ কেন ছুঁতে দাও না...? তোমার কাছ থেকে বার বার এই প্রশ্নের উত্তর জানতে গিয়ে আমি হতাশ হয়েছি...কি আছে এই কাঠ গোলাপে...?? তোমার আমার বিয়ের দিন রাতে তুমি আমাকে বললে “আপনার কাছে একটা জিনিস চাইব...আমাকে plz না করবেন না । আমাকে একটা কাঠ গোলাপের চারা এনে দিবেন... আমি বাগানের দক্ষিণ কোণে লাগাবো...জানালা দিয়ে দক্ষিণা বাতাসে কাঠগোলাপ আমায় ছুঁয়ে যাবে ...”
থাক ... থাক আর বলতে হবে না ... সব মুখস্ত হয়ে গেছে তাই না....সকাল সকাল এত কিছু না বললে হয় না...বয়স তো বাড়ছে সেটা মনে আছে...আর ঘরে যে আমাদের ক্লাস নাইন এ পড়া একটা মেয়ে আছে সে বিষয়ে খেয়াল আছে...এসব শুনলে সে কি ভাব্বে ??
রোদ...রোদ... মামনি ঘুম থেকে উঠো ... এই রোদ ...... !!
প্রায় প্রতিটা সকালে বাবা-মা’র এমনি কিছু কথা শুনে আমার ঘুম ভাঙ্গত...আমার বাবা মাকে খুব ভালো বাসত...আজ ২৫ দিন হয় মা মারা গেছে... সকাল বেলার বাবা আর মা’র ঐ কথাগুলোকে অনেক miss করতেছি...সকাল বেলা কেউ আর ডাকবে না “রোদ” বলে...কপালে চুমু দিয়ে বলবে না মামনি ঘুম থেকে উঠো...আমি ঘুম থেকে উঠে যখন মা কে জড়িয়ে ধরতাম মা’র শরীর থেকে কাঠ গোলাপের সুন্দর একটা গন্ধ আসতো...মা যে কেন কাঠগোলাপের এত পাগল ছিল তা জানতাম না... বাবাও জানত না...!! মা কাঠগোলাপ দেখলে দিশেহারা হয়ে যেত...
ঠিক ২৫ দিন আগে বিকাল বেলা ঝুম বৃষ্টির মধ্যে আমি, বাবা আর মা মিলে গাড়িতে করে যাচ্ছিলাম সেন্ট্রাল রোড দিয়ে ...ঐ রোডের মাঝা-মাঝি একটা বড় কাঠগোলাপ গাছ আছে। ঐ রোড দিয়ে মা যখনি যায় তখন রাস্তায় কোন কাঠ গোলাপ পড়ে থাকলে মা গাড়ি থেকে নেমে ফুলগুলোকে কুঁড়িয়ে আনত । এবারও মা গাড়ি থেকে নেমে কাঠ গোলাপ আনতে গেল... বাবা মানা করল যেও না বৃষ্টিতে। বৃষ্টিতে কাঠ গোলাপ দেখলে মা দিশেহারা হয়ে যেত ... বুঝতাম না কেন ?? মা শুনলো না বাবার কথা ...... অনেক কাঠগোলাপ রাস্তায় আর ফুটপাথে পড়ে ছিল... গাড়িটাকে ড্রাইভার চাচা রাস্তার অন্য দিকে অনেক পিছনেই রেখে ছিলেন... আমি আর বাবা গাড়িতে বসে মা’র কাঠগোলাপ কুঁড়ানো দেখছিলাম...বাবা বলছিল তোর মা একটা পাগল, যখন ঠাণ্ডা লাগবে তখন বুঝবে... মা ফুটপাথের সব ফুলগুলোকে কুঁড়িয়ে নেবার পর রাস্তার ফুলগুলোকে কুঁড়াবার জন্য নিচে নামলো আর বৃষ্টিও বেড়ে গেল...দেখা যাচ্ছিলো না সবকিছু ঠিকমত। অনেক বৃষ্টির সাথে দমকা হাওয়া... মা পিছন ফিরে ফুল কুঁড়াচ্ছিল। হঠাৎ একটা পিকাপ ভ্যান সজোরে মাকে পাশ থেকে ধাক্কা মেরে চলে গেল। আমি আর বাবা একটা চিৎকার দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে দেখলাম সব শেষ... মা নিথর হয়ে পড়ে আছে রাস্তায় ।মা’র মাথা ফেটে রক্তে রাস্তা একাকার...বৃষ্টিতে রক্ত ধুয়ে যাচ্ছিলো... আর পাশে ছড়িয়ে ছিল কিছু রক্তে রাঙ্গা কাঠগোলাপ... ল্যাব এইড হসপিটালে মাকে নিয়ে যাবার পর ডাক্তাররা মাকে মৃত ঘোষণা করলেন। বাবা মাকে আমাদের বাড়ির বাগানে মা’র প্রিয় কাঠগোলাপ গাছের নিচে কবর দিলেন। এখন আর ঋজু চাচাকে কেউ বকা দেয় না, বলে না বিদায় করে দিবে। চাচা এখন প্রায় কাঁদে আর কাঠগোলাপ ঠিকই মাটিতে পুঁতে রাখে।
..........................
রোদ...রোদ... মামনি ঘুম থেকে উঠ ... এই রোদ !!! না মা না বাবা ডাকছে...
-বাবা আমি অনেক আগেই উঠেছি...
মামনি নাস্তা খেয়ে নিস... আমি অফিসে গেলাম...
ঠিক তখন দরজার কড়া নেড়ে ঋজু চাচা আমাকে বললেন... মামনি আমি একটা চাবি পেয়েছি তোমার মা’র Reading room এর কাছে...
চাচা আমি না তোমাকে বলেছি ঐ room এর কাছে তুমি যাবে না... বাবা পছন্দ করে না ... দেখ না আমিও যাই না।
না মামনি আমি ঐ room ঢুকি নাই। ঝাড়ু দেবার সময় দেখলাম দরজার কাছে এই চাবিটা পড়ে আছে …
চাবিটা দেখে মনে হল কোন ড্রয়ার এর চাবি...আচ্ছা চাচা তুমি যাও...বাবা বাড়িতে নেই... আজ মা’র Reading room -এ ঢুকব। যা ভাবা তাই কাজ...পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে চাবিটা ঢুকাতেই ড্রয়ার খুলে গেল। টান দিয়ে খুলতেই কাঠগোলাপের গন্ধ পেলাম... ভিতরে কিছু শুকনো কাঠগোলাপ আর একটা পুড়নো ডাইরি। কাভারটা খুলতেই দেখি নাম লিখা “অরণ্য আরিয়ান” আর তার কিছু নিচে লেখা “মেঘলা”। ভিতরে অনেক কিছু লিখা... প্রথমে এক ধরনের হাতের লেখা ...কয়েক পৃষ্ঠা পর আমার মায়েরও হাতের লিখা ...খুঁজে পেলাম। অনেক অবাক হলাম...ডাইরিতে আম্মুর নাম ... আবার আম্মুর হাতের লেখা ??
কিছু তো একটা আছে ডাইরিটাতে...অনেক কৌতূহল নিয়ে পড়তে ডাইরিটা পড়তে লাগলাম। প্রথম কয়েক পৃষ্ঠা এমনি লিখা ছিল...
“- এই যে আপনি, শুনছেন ??
আমাকে একটা ফুল পেড়ে দিন না
এই যে Mr !! আরে হ্যাঁ আপনাকে বলছি !! Plz একটা ফুল পেড়ে দিন না...??
[আষাঢ়- শ্রাবণ মাস ... কয়েকদিন ধরে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে ... আজ ছাতা আনতে ভুলে গেছি। বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে বাসায় যাচ্ছিলাম । একটু আগে স্টুডেন্টের বাসা থেকে বের হয়েছি... আগের থেকে বৃষ্টি আরও বেড়েছে... ঝুম বৃষ্টি সাথে দমকা হাওয়া... ভালোই লাগছিল। রাস্তায় দেখি একটা মেয়ে বৃষ্টির মধ্যে লাঠি দিয়ে কাঠ গোলাপ পাড়ার বৃথা চেষ্টা করছিল... ফুলগুলো ছিল ওর নাগালের বাইরে। এই দৃশ্য দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিলাম... হঠাৎ ......এই যে আপনি, শুনছেন ?? ]
আমি ??
-হ্যাঁ , আপনি ... Plz একটা ফুল পেড়ে দিন না ...কাঠগোলাপ আমার অনেক প্রিয় ফুল। বৃষ্টিতে ভিজলে ফুলগুলোকে অনেক সুন্দর লাগে...সাদা ফুলের মাঝে হলুদের আভা... plz..দিন না।
[মনে মনে ভাবছিলাম... আরে মহা মছিবতে পরলাম তো। চিনি না জানি না ... বৃষ্টির মধ্যে একটা মেয়ে বলে ফুল পেড়ে দিন !!]
-আরে মশাই কি এত ভাবছেন... দেখছেন যে ফুলগুলো আমার নাগালের বাইরে ।
আচ্ছা দিচ্ছি...
[ ওর হাতের লাথিটা নিয়ে আমি বৃষ্টির মধ্যে গাছে উঠে ওকে এক থোকা ফুল পেড়ে দিলাম। ]
এই যে আপনার কাঠ গোলাপ...
-Thnx… many many thanx…. আচ্ছা আমি যাই ...by
[মেয়েটা অনেকটা সামনে গিয়ে...পিছনে ফিরে আবার কাছে এসে...]
-Ooo Sorry…!!! আমি মেঘলা , আপনি ?
আমি অরণ্য ...
-আপনি কি করেন ?
এইতো বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় ঘুরি-ফিরি , আর মাঝে মাঝে মেয়েদের ফুল পেড়ে দেই।
-Hahaha......হাসালেন... ,রাগ করেছেন আপনাকে ফুল পাড়তে বলার জন্য ??
না রাগ করবো কেন ...এমনি দুষ্টামি করলাম । ”
[আমি অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে দেখছিলাম... কি সুন্দর ভাসা ভাসা চোখ... কাজল দেয়াছিল চোখে...। বৃষ্টিতে চোখের কাজল ধুয়ে পড়ছিল গোলাপি গালদুটো বেয়ে... সেই দিকে তার মোটেও খেয়াল ছিল না]
..........................
“রোদ... মামনি তুমি কোথায়... খাবে না ?” ঋজু চাচা খেতে ডাকছে ...
আরে !! এই লোকটা তো আমার আম্মুর কথাই তার ডাইরিতে লিখেছে । আম্মু যখন চোখে কাজল দিত তখন আম্মুকে অনেক সুন্দর লাগত। আমি ডাইরিটা সাথে করে নিয়ে এলাম... খাওয়া শেষ করে আবার পড়তে শুরু করলাম...
..........................
আমি CSE তে পড়ি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে...
আপনি?
-আমি মাত্র SSC দিলাম...
তা আপনি কি এইখানে থাকেন ?
-হ্যাঁ... ওইটা আমাদের বাসা...
আচ্ছা আজ আমি আসি... আর একদিন কথা হবে...
-আচ্ছা, ভালো থাকবেন।
[কয়েক দিন পর আমি রিক্সায় করে একটা স্কুলের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। সেদিনও বৃষ্টি ছিল...তবে অল্প... কি যেন মনে হল ভাবলাম নেমে আম ভর্তা খাব... গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে আম ভর্তা ভালোই লাগবে একটু টক একটু ঝাল...যদিও তখন আমের সিজনের যাই যাই অবস্থা । মুখে দিতে যাচ্ছিলাম ... ]
-এই যে আপনি ? অরণ্য ...একা একা আম খাচ্ছেন ?? এটা কি ঠিক ?
আরে আপনি কেমন আছেন?
-হুম ভালো... আমিও আম ভর্তা খাব।
[কি মেয়েরে বাবা একবার বলে ফুল পেড়ে দিন এখন আবার আম ভর্তা !! আমরা দুজন মিলে আম ভর্তা খাচ্ছিলাম। বেখেয়ালি বৃষ্টি হঠাৎ বেড়ে গেল... আমি দুষ্টামি করে বললাম.........]
আজও কি কাঠগোলাপ পেড়ে দিতে হবে ??
-আল্লাহ ... আমার মনেই ছিল না !! thnx…হুম দিতে হবে... চলেন...
[কি আর করা খাল কেটে কুমির আনলাম আমি...গেলাম দুজন মিলে ওদের বাড়ির সামনে ফুল পাড়তে। এভাবেই বৃষ্টিতে আমাদের দিন গুলো যাচ্ছিলো... একটা বিষয় খেয়াল করে দেখলাম বৃষ্টিতে মেঘলার সাথে আমার প্রায় দেখা হয়... অন্যথায় হয় না...মেয়েটার মায়ায় আটকে গেলাম। জীবনের এত গুলো শ্রাবণ পার করে দিলাম কিন্তু তেমন কেউ এল না যাকে নিয়ে শ্রাবণে ভিজবো। যে শুধু থাকবে আমার অনুভূতি জুড়ে । যাকে সাথে নিয়ে বৃষ্টি ভেজা কোন পথের বাঁকে কাকভেজা হব।
রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা মনে পড়ে গেল
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না.....
কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না.... ]
..........................
ডাইরির পরের পেজেগুলো খুঁজে অরণ্যের আর কোন লেখা পেলাম না ।
প্রায় শেষের দিকে আমার আম্মুর কিছু লেখা পেলাম...আর কিছু কাজল ধোয়া ফোঁটার ছাপ পেলাম লেখাগুলোতে । সবার প্রথমেই লেখা...
“ বিধাতা এমন কেন অরণ্য ? কেন আমার কাছ থেকে তোমাকে কেঁড়ে নিল...??”
[ ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে তুমি আমার বাসার সামনে আসলে... আমি বারান্দায় ছিলাম। তোমাকে দেখে তোমার সাথে বের হলাম... আজ আর বললাম না কাঠগোলাপ চাই... বললাম...... ]
- আপনি কি পারবেন, আমাকে একটা বৃষ্টিভেজা কদম ফুল এনে দিতে ?
ভেজা কদমের পাপড়িগুলো ছড়িয়ে দেবে আমার মনে, প্রানে...
হুম দিব...চলেন ...
[ তুমি আর আমি মিলে চলে গেলাম আমার স্কুলের কাছে... স্কুলে একটা কদম গাছ ছিল। যখন আকাশ ভেঙ্গে মুষল ধারে বৃষ্টি নামতে লাগল তুমি আমি গিয়ে দাঁড়ালাম ঐ কদম গাছের নিচে।বৃষ্টির ফোঁটা ভেজা কদমের পাপড়ি ছুঁয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল আমাদের উপর। আর থাকতে পারলাম না বৃষ্টির কারণে। তুমি বললে... ]
চলেন... স্কুলের ভিতরে যাই।
[ তুমি আর আমি একটা ক্লাস রুমে গিয়ে ঢুকলাম ।দুজনেই ভিজে চুপচুপে ।আমি শীতে অনেক কাঁপছিলাম... ইচ্ছা করছিল তোমায় জড়িয়ে ধরি। তোমাকে অনুভব করি অন্তরের গহীনে হৃদয়ের অন্তরালে। আমি যে তোমাকে ভালবেসে ফেলেছিলাম অরণ্য ।আমি জানলার গ্রিল ধরে দাড়িয়ে ছিলাম হঠাৎ তুমি বললে.........]
"আকাশের কিছু দুঃখ আছে তাই অঝোরে ঝরে বৃষ্টি হয়ে কান্না ঝরায় "
- তাই ...??
হুম...
আকাশ তার অবিরাম বৃষ্টির ধারায় খুঁজে ফেরো অনেক প্রশ্নের উত্তর... সরল, গড়ল, পাওয়া না পাওয়ার আরও অনেক ...আর তুমি আমি খুঁজে ফিরি আমাদের
[ এই প্রথম তুমি আমাকে তুমি বললে...]
খোলা জানালা, অবিরাম বৃষ্টি । বৃষ্টি ধারায় ভেসে যাব শুধু আমরা দুজনে...
জানালার গ্রিল ধরে তুমি -আমি বৃষ্টি দেখি... আর অদূর ভবিষ্যতের ভাবনার অতলে ডুবে যাই। তুমি হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখলে আকাশের জল কান্না, আর ছিটিয়ে দিলে আমায়, আমি হাসলাম...
তুমি বললে -এখন তুমি বেশ ভালোই জানো বৃষ্টি রহস্য, চিনতে শিখেছ বৃষ্টির জল কান্না, কালো মেঘদের অর্থ...
[ হটাৎ আমার চোখের কার্নিশ গড়িয়ে ঝরে পড়তে লাগল অঝোর শ্রাবণ... তুমি দিশেহারা হয়ে বললে ......]
ভয় পেও না...আজ আমি আছি তোমার পাশে... থাকব চিরকাল...
আর আমার দু চোখের অশ্রু মুছিয়ে দিলে তোমার অপার ভালোবাসায়.... আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম । আমি ঠিক এই মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষায় ছিলাম।
বৃষ্টি শেষে যখন তুমি আমায় ছেড়ে যাচ্ছিলে আমি বলেছিলাম... কাল আমার সাথে স্কুলের সামনে দেখা করবে ১১ টায়... কাঠগোলাপ নিয়ে আসবে কিন্তু...তুমি হাসলে আর বললে আমার ডাইরিটা কাল আমি তোমায় দেব...এখন থেকে তুমি লিখবে...
আচ্ছা দিও...আমি এখন যাই।
সারাটা রাত আমার ঘুম আসছিল না... এত খুশি ছিলাম... আমি তোমায় পেয়েছি আর কি চাই...আর ভাবছিলাম কখন যে সকাল হবে আর তোমায় দেখব...
সকাল বেলা প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টির মধ্যেও আমি ১০.৩০-এ স্কুলের সামনে হাজির। বার বার হাত ঘড়ি দেখছিলাম... কখন যে ১১ টা বাজবে, আর তুমি আসবে। আমি স্কুলের গেটের সামনেই ছোট্ট একটা ছাউনির নিচে ছিলাম। আর তোমার পথের পানে তাকিয়ে ছিলাম। ১১ টা বাজার ঠিক ৫ মিনিট আগে তোমাকে দেখলাম তুমি রিক্সায় । হাতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ আর এক ছোপা কাঠগোলাপ ফুল , ফুলগুলো বৃষ্টিতে ভিজছিল। আমি দৌড়িয়ে গেলাম তোমার দিকে... তুমি রিক্সা থেকে নেমে একটু হেসে আমার দিকে যেই এক পা বাড়ালে...হঠাৎ কোথা থেকে একটা গাড়ি এসে তোমায় ধাক্কা মারল। মনে হল আমার পৃথিবী থমকে গেছে। তোমার হাত থেকে প্লাস্টিকের ব্যাগটা ছিটকে গেল।তুমি রাস্তায় পড়ে আছ। তোমার মাথা ফেটে রক্তে রাস্তা একাকার...বৃষ্টিতে রক্ত ধুয়ে যাচ্ছিলো... আমি কাছে গিয়ে দেখলাম তোমার ঠোট দুটি কাঁপছিল... আর তখনও হাতে ছিল কাঠগোলাপ...আমি তোমার কাছে গিয়ে মাথাটা আমার কোলে রাখতেই তুমি আমাকে বলেছিলে মেঘলা আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি... অনেক। নিথর হয়ে পড়ে রইলে তুমি আমার কোলে আর নির্বাক আমি । আমাদের ঘিরে ছিল রাস্তার মানুষগুলো...
আমার আর বুঝতে বাকি রইল না আম্মু আর বৃষ্টি ভেজা কাঠগোলাপ রহস্য ।তারই অনেকগুলো পৃষ্ঠার পর আম্মুর আরও কিছু লেখা পেলাম...
“অরণ্য জানো... আমি এখন বিবাহিত...আমার একটা মেয়েও আছে। তার নাম রোদ। জানো আমাদের বাড়ির দক্ষিণ কোণে আমি একটা কাঠগোলাপ গাছ লাগিয়েছি। বার মাস সেটাতে ফুল ফোটে আর আমাকে তোমার কথা মনে করিয়ে দেয়। আমি এখন একাই কাঠগোলাপ পাড়ি...তোমাকে লাগে না। জানো আমার Husband আমাকে অনেক ভালবাসে, আমিও চেষ্টা করছি তাকে ভালবাসার। কিন্তু কেন যেন পারছি না। আমি তাকে কোন দিন বলিনি তোমার আমার কথা। অরণ্য আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি... অনেক। তাই বলে আমি আমার Husband কে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করি নি । তাকে আমি তোমার আমার কথা বলি নি কেন জানো ??
কারণ সে থাকে শীতল নীড়ে , শত আনন্দের ভীড়ে...আমি চাই সে এভাবেই থাকুক। আমি ভাল আছি আমার জগৎটাকে ঘিরে...আজো আমার স্বপ্ন ছেড়া কল্পনাতে তোমার বসবাস... হয়ে তুমি আমার দীর্ঘশ্বাস....”
..........................
No comments:
Post a Comment